রক্ষা হবে ভোক্তাস্বার্থ ॥ চলতি মাসেই ই-কমার্স নির্দেশনা জারি
প্রকাশিত : 10:30 AM, 23 December 2020 Wednesday

সবার আগে ভোক্তা স্বার্থ নিশ্চিত করতে ই-কমার্স ব্যবসা আইনী কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার লক্ষ্যে ডিজিটাল কমার্স ব্যবসা পরিচালনা সংক্রান্ত নির্দেশনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। চলতি মাসের শেষ নাগাদ এই নির্দেশনা জারি করা হবে। এই নির্দেশনার মধ্যে থেকেই চালাতে হবে ই-কমার্স। সম্প্রতি ই-ভ্যালির কার্যক্রম নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর ই-কমার্স ব্যবসা পরিচালনার বিষয়টি নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করে সরকার। ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় নতুন নীতিমালাসহ নির্দেশনা তৈরি করার কাজে হাত দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আপাতত নির্দেশনা জারি হলেও খুব তাড়াতাড়ি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। ডিজিটাল ব্যবসাকে পলিসি সাপোর্ট দিতে গঠন করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত এই সেল ডিজিটাল কমার্স ব্যবসা পরিচালনা সংক্রান্ত নির্দেশনাটি চূড়ান্ত করেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নেয়ার পর সাত থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সুনির্দিষ্ট পণ্য ডেলিভারি দিতে হবে। নতুন এই নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, যেসব কোম্পানির পণ্য বিক্রি করা হবে সেই প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব থাকবে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর। বিক্রীত পণ্যের গুণগত মান নিয়ে কোন অভিযোগ উঠলে তা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহি করতে হবে। পণ্য ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হলে গ্রাহকের টাকা মানি ওয়ালেটে রাখার সুযোগ থাকছে না। এমনকি সুনির্দিষ্ট পণ্য ব্যতীত অন্য পণ্য গছিয়ে বিক্রি করার সুযোগ রাখা হয়নি। মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম কোম্পানির আদলে গ্রাহকের কাছ থেকে লোভনীয় শর্তে অর্থ গ্রহণ করার সুযোগ নেই। পণ্যবিক্রি আকর্ষণে লটারি করার সুযোগ রাখা হয়নি।
ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ডিজিটাল কমার্স ব্যবসায়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে পরিচালনা সংক্রান্ত নির্দেশনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। চলতি মাসের শেষ নাগাদ নির্দেশনাটি প্রকাশ করার উদ্যোগ রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। নতুন নির্দেশনা প্রকাশ হওয়ার পর এই নির্দেশনা অনুসরণ করে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে। ভোক্তা স্বার্থে নির্দেশনার বাইরে কারও ব্যবসা করার কোন ধরনের সুযোগ থাকছে না। ডিজিটাল ব্যবসা দ্রুত দেশে সম্প্রসারণ হচ্ছে। অনেকে ফেসবুকের মাধ্যমে ব্যবসা করছেন। এখন সবাই এর সুযোগ নিচ্ছেন। আইনী কাঠামোর বাইরে যে কোন ব্যবসা বা বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড অবৈধ। এ কারণে এই ব্যবসা পুরোপুরি আইনী কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে কাজ করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ফেসবুকে আইডি খুলেই কয়েক লাখ প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। এর বাইরে নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট খুলে হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান ই-কমার্স বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। সরকারের হিসাবে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে মাত্র ১ হাজার ৩০০টি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই তেরোশ’টি প্রতিষ্ঠানের দিকে নজর দিতে পারছে। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে পরিচালনা করা হয় তার কোন তথ্য নেই সরকারের কাছে। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে অনলাইন প্রতিষ্ঠান। ক্রেতারা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কিনে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন। এ কারণে পুরো ব্যবসাটি আইনী কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা না গেলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সঙ্কট তৈরির আশঙ্কা আছে সংশ্লিষ্টদের। ইতিপূর্বে এমএলএম কোম্পানি খুলে ডেসটিনি, যুবকসহ অসংখ্য কোম্পানি প্রতারণার মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। পরবর্তীতে আইন করে এসব প্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। ই-কমার্স ব্যবসাকেও আইনী কাঠামো ও পলিসি সহায়তা দেয়া না গেলে এ খাতেও অপতৎপরতা ও কারসাজির সুযোগ নিতে পারে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকের পক্ষ থেকে অভিযোগ ওঠায় সেগুলো তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, যে কোন ব্যবসা পরিচালনা করতে হলে নীতিমালা ও এ সংক্রান্ত আইন-কানুন মেনে করতে হবে। ডিজিটাল ব্যবসা যা নতুন এক ধরনের ব্যবসা দেশে দ্রুত সম্প্রসারণ হচ্ছে। অনেকেই এ খাতে বিনিয়োগ করছেন, ভোক্তাদেরও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। আর এ কারণে ডিজিটাল ব্যবসা পরিচালনা সংক্রান্ত কয়েকটি নীতিমালা প্রণয়নের কাজ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। শীঘ্রই ই-কমার্স ব্যবসা সংক্রান্ত নির্দেশনা প্রকাশ করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ভোক্তা ও গ্রাহক স্বার্থ সবার আগে। আর এ কারণে নির্দেশনা মেনেই ই-কমার্স ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সামগ্রিক অর্থনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ডিজিটাল বাণিজ্য। করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেক ব্যবসা-বাণিজ্যই এখন অনলাইনমুখী হয়েছে। চাহিদার প্রয়োজনে ই-বাণিজ্যের দ্রুত প্রসার হচ্ছে অভ্যন্তরীণ বাজারে। ভোক্তা তথা ক্রেতাদের স্বার্থের বিষয়টি নতুন নীতিমালায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। পরিচালনা নীতিমালা অনুযায়ী কোন ক্রেতা সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চুক্তি ও শর্ত অনুযায়ী পণ্য ডেলিভারি না পেলে প্রচলিত ভোক্তা আইনে মামলা করতে পারবেন। এছাড়া ভোক্তারা কখন কিভাবে অর্থ পরিশোধ করবেন সে লক্ষ্যে ডিজিটাল কমার্স পেমেন্ট সংক্রান্ত একটি নীতিমালা করা হচ্ছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চলতি বছরের মধ্যে ই-কমার্স পরিচালনা নীতিমালা আইনটির খসড়া করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়া আগামী বছরের শুরুতে ডিজিটাল কমার্স পেমেন্ট সংক্রান্ত আইনটির খসড়া করে মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।
করোনা মহামারীর মতো বর্তমান দুর্যোগে নগরবাসীর অনেকের কাছে ভরসা হয়ে উঠেছে অনলাইন শপিং। অনলাইন শপিংয়ে প্রতিদিন ৫০ হাজার পণ্যের ডেলিভারি হচ্ছে। শুধু অনলাইনে বছরে বেচাকেনা হচ্ছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার। এ খাতে এসেছে বিদেশী বিনিয়োগ। আলিবাবা, আমাজন ও দারাজের মতো বিশ্বসেরা ই-কমার্স কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। বিদেশী কোম্পানিগুলো ই-কমার্স খাতে ৪৯ শতাংশ বিনিয়োগ করার সুযোগ পাচ্ছে। এছাড়া বাকি ৫১ শতাংশের মালিকানা সরকার কিংবা বেসরকারী খাতের উদ্যোক্তারা। এ কারণে যৌথ বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। ই-কমার্সে ভোক্তাদের স্বার্থ নিশ্চিত করতে আরও কঠোর হচ্ছে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর।
এ কারণে অধিদফতর ভোক্তা অধিকার সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের মার্কেট প্লেস, উদ্যোক্তা, ডেলিভারি সিস্টেম, পেমেন্ট সিস্টেম ইত্যাদির মধ্যে চুক্তি সম্পাদন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ডিজিটাল কমার্স সংশ্লিষ্ট পেমেন্ট ও পণ্য ডেলিভারির ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট অপারেশনাল গাইডলাইন প্রণয়ন করা হবে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় গঠিত কেন্দ্রীয় সেলকে এ বিষয়ে সকল মন্ত্রণালয়, বিভাগ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় সাবধনের জন্য নিদের্শনা দেয়া হয়েছে। ভোক্তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোড অব কন্ডাক্ট প্রণয়ন করা হবে। এতে ই-কমার্স পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অপরাধ প্রমাণিত হলে আইনী কাঠামোর মাধ্যমে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারবে সরকার। ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইক্যাব) জানায়, এ খাতে ২০ হাজার দেশীয় উদ্যোক্তা কাজ করছেন। অনেকে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিক্রি করছেন। আবার কেউ ফেসবুকের মাধ্যমে পণ্যসামগ্রী বিক্রি করছেন। এ প্রসঙ্গে ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক মোঃ আবদুল ওয়াহেদ তমাল সম্প্রতি জানান, দেশে ই-কমার্স ব্যবসার দ্রুত প্রসার ঘটছে। তবে এই প্রযুক্তির সঙ্গে সবাই পরিচিত নয়। এ কারণে ব্যবসায়িক অবকাঠামোগত কিছু দুর্বলতা রয়ে গেছে। এরপরও দেশের ই-কমার্স খাতে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।
বর্তমানে ফেসবুকে বিভিন্ন পেজ বা গ্রুপের মাধ্যমেও কেনাকাটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনেকেই ব্যক্তি উদ্যোগে পেজ খুলে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য সাইট কোনটি তা বোঝা কঠিন। অনেকে বিক্রির নামে প্রতারণা করায় এর প্রভাব পড়ছে দেশের ই-কমার্সের ওপর, যা ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থার প্রসার তথা ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে অনলাইন পণ্য কিনে প্রতারিত হলে নির্দিষ্ট প্রমাণ সাপেক্ষে দেশের ভোক্তা অধিকার আইনে অভিযোগ করা যেতে পারে। কিন্তু প্রচার না থাকার কারণে সে আইনের প্রক্রিয়া ও নিয়ম-কানুন বেশিরভাগ মানুষের অজানা। তবে এই ব্যবসার সম্প্রসারণ করতে হলে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় সবাইকে আনতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, করোনাকালে ই-কমার্স বাণিজ্য দেশে দ্রুত সম্প্রসারণ হচ্ছে। ক্রেতারা ঘরে বসে অনলাইনে অর্ডার করে পণ্য পাচ্ছেন। অর্ডার গ্রহণ থেকে শুরু করে ডেলিভারি পর্যন্ত তিন স্তরে মানুষ কাজ করছে। ফলে বাড়ছে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ। তিনি বলেন, সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ই কমার্স বাণিজ্য দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। কিন্তু অদক্ষতা ও অনিয়ম বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্ডার মতো পণ্য না পাওয়া একটি বড় সমস্যা। এসব দূর করতে হলে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে ই-কমার্স বাণিজ্য পরিচালনা করতে হবে। জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল আগামী বছরের মধ্যে ই-কমার্স সংক্রান্ত নতুন নীতিমালাগুলো প্রণয়নের কাজ শেষ করে আনতে চায়। এর আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, বিভাগ ও স্টেকহোন্ডারদের সঙ্গে আরও কয়েকটি বৈঠক করা হবে।
শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক গণঅধিকার'কে জানাতে ই-মেইল করুন- dailyganoadhikar@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
দৈনিক গণঅধিকার'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।