মাদকেই যত সর্বনাশ ॥ মাদকাসক্তরাই আশি ভাগ ধর্ষণে জড়িত
প্রকাশিত : 11:58 AM, 7 October 2020 Wednesday

দেশে সংঘটিত শতকরা প্রায় আশি ভাগ ধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা ও খুনের সঙ্গে মাদকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশই মাদকে আসক্ত থাকে। সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির পরও কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না মাদক। মাদক সেবন করার পরে অনেকের মধ্যে এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত করার মানসিকতা সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ধর্ষণ ও ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার ক্ষেত্রে মাদক বেশি প্রভাব ফেলে। অনেকেই মাদক সেবনের পর পরিবেশ পরিস্থিতির সুযোগে ধর্ষণ ও ধর্ষণ পরবর্তী হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের নিরোধ ও গবেষণা শাখা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে এমন তথ্য মিলেছে। সম্প্রতি ধর্ষণ নিয়ে রীতিমতো হৈচৈ চলছে। ধর্ষকদের শাস্তির দাবিতে সারাদেশে আন্দোলন ও বিক্ষোভ করছেন সাধারণ মানুষ।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র বলছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি রাত নয়টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা ব্যাপক আলোচনায় আসে। র্যাবের সাঁড়াশি অভিযানে গ্রেফতার হয় ধর্ষক মজনু। আদালতে এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচার চলছে। র্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম ধর্ষক মজনুকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জনকণ্ঠকে জানান, মজনু পুরোপুরি মাদকাসক্ত। সে হেরোইন ও ইয়াবার মতো মাদক সেবন করত। সে হেন কোন মাদক নেই যা সেবন করত না বলে জানায়। মাদক সেবনের পর এভাবে বহু নারীকে সে ধর্ষণ করেছে। যা কোন সময়ই আলোচনায় আসেনি। সুযোগমতো কোন নারীকে একা পেলেই টার্গেট করত। রাতের নির্জন জায়গায় বিপদগ্রস্ত নারীরাই ছিল তার টার্গেট। জোরপূর্বক তুলে নিয়ে ধর্ষণ করত। মজনুর ভাষ্য মোতাবেক, হেরোইন বা ইয়াবা সেবন করার পর তার আর হিতাহিত জ্ঞান থাকত না। তার গায়ে জোর বেড়ে যেত। জোরজবরধস্তি করে কোন মেয়েকে সুবিধাজনক জায়গায় একা পেলেই তুলে নিয়ে ধর্ষণ করত।
সম্প্রতি সিলেটে স্বামীর সামনে থেকে স্ত্রীকে তুলে নিয়ে সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ধর্ষণের ঘটনায় সারাদেশে তোলপাড় চলছে। এ ঘটনায় ৮জন গ্রেফতার হয়ে আদালতে ধর্ষণের দায় স্বীকার করেছে। পুলিশ বলছে, ধর্ষণে জড়িতদের প্রায় সবাই মাদকসেবী। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্বামীর জন্য রক্ত আনতে গিয়ে ধর্ষণের ঘটনায় তিন জনকে গ্রেফতার করে র্যাব। গ্রেফতারকালে ধর্ষকরা মাদক সেবন করছিল। এছাড়া চলতি বছরের ১৩ মার্চ দিবাগত রাতে কাওলার ঝোপে এক কিশোরী গণধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত ধর্ষক আলমগীর ওরফে পায়তারা আলমগীর (২৬), জালাল উদ্দিন ওরফে বাবু (২০), রুবেল হাওলাদার (৩০) ও ধর্ষণে সহায়তাকারী শিল্পী খাতুন (২৪) মাদকসেবী। এর বাইরে রামপুরায় মাদকাসক্ত বাবুর্চির দুই বোনকে ধর্ষণ, ঈদে নতুন জামা কাপড় দেয়ার কথা বলে তুরাগের কামারপাড়ায় শিশু ধর্ষণ, খিলক্ষেত বেড়াতে গিয়ে এক নারী ধর্ষণ, ঢাকার দোহার উপজেলায় হত্যার ভয় দেখিয়ে কিশোরীকে একাধিকবার ধর্ষণ, চিকিৎসার কথা বলে গাজীপুরের শ্রীপুরে এক রোগীকে বাংলোতে নিয়ে ধর্ষণ, মিরপুরে গৃহকর্মী ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের সবাই মাদকসেবী। সর্বশেষ নোয়াখালীতে গৃহবধূকে ধর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বিবস্ত্র করে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনার সঙ্গেও মাদকের সংশ্লিষ্টতা আছে। ইতোমধ্যেই গ্রেফতারকৃত চার জন মাদক সেবনে অভ্যস্ত বলে তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, এছাড়াও গত বছর ঢাকার গে-ারিয়ায় ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে আয়েশা নামের এক শিশুকে বাড়ির তিনতলা থেকে ফেলে হত্যা, ইয়াবা সেবনের পর ৭ জানুয়ারি ডেমরার কোনাপাড়ার একটি বাসায় লিপস্টিক দেয়ার লোভ দেখিয়ে ফারিয়া আক্তার দোলা (৫) ও নুসরাত জাহান (৪) নামে দুই শিশুকে ডেকে বাসায় নিয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক গোলাম মোস্তফা (২৮) ও তারই মামাত ভাই আজিজুল বাওয়ানীর (৩০) ধর্ষণের পর হত্যাসহ প্রায় সকল ধর্ষণ ও ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা এবং খুনের তদন্তে কোন না কোনভাবে মাদকের সম্পৃক্ততা মিলেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের নিরোধ ও গবেষণা শাখার তথ্য মোতাবেক, দেশে বর্তমানে মাদকসেবীর সংখ্যা দুই কোটি। যার মধ্যে এক কোটি মাদকাসক্ত। বাকি এক কোটি অনিয়মিত মাদকসেবী। এসব মাদকসেবীরা সাধারণত ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা, আফিম, ভাং, চরোস, ড্যানড্রাইড (জুতোর আঠা) ও মদ বা এ্যালকোহল সেবন করে থাকে। তবে পেশাদার মাদকসেবী বা মাদকাসক্তদের অধিকাংশই ইয়াবা, ফেনসিডিল ও হেরোইনে আসক্ত। আর গাঁজা, আফিম, ভাং ও চরোসের মতো মাদক সমাজের নানা শ্রেণীর পেশার মানুষ সেবন করে থাকে। তবে তাদের পুরোপুরি মাদকাসক্ত হিসেবে ধরা যায় না। আর হালের ড্যানড্রাইড বা জুতোর আঠাও আলোচনায় এসেছে। এই মাদক পলিথিনের ভেতরে রেখে মুখে পলিথিন লাগিয়ে নিশ্বাস নেয়। এ ধরনের মাদক সাধারণত পথশিশুদের সেবন করতে দেখা যায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গবেষণা মোতাবেক, হেরোইন, ইয়াবা ও এ্যালকোহল সেবনকারীদের মধ্যে ধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা এবং খুনের মতো অপরাধে জড়িত থাকার প্রবণতা এবং সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। অন্যান্য মাদক সেবনকারীরাও ধর্ষণের মতো অপরাধ করে। তবে সে সংখ্যা কম।
ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন ঢাকায় গড়ে মাদকের সঙ্গে জড়িত ৫০ জন গ্রেফতার হয়। শুধু ঢাকায় নয়, সারাদেশের চিত্রও প্রায় একই। মাদক সংশ্লিষ্টতায় সবচেয়ে বেশি গ্রেফতারের ঘটনা ঘটে। সারাদেশে মাদক আইনে মামলা দায়েরের সংখ্যা অন্যান্য অপরাধের তুলনায় অনেক বেশি। প্রতিদিন গড়ে সারাদেশে তিন শতাধিক মাদকের মামলা হয়। ইয়াবা সেবনের পর কে কি তা দেখারও প্রয়োজন মনে করে না সেবীরা। তারা নিজেদের যেকোন ধরনের অসুবিধা মনে করলেই যে কাউকে যেকোন ধরনের আঘাত করতে পারে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইয়াবা সেবনের পর তল্লাশির মুখে পড়ে ঢাকার বংশাল থানার এসআই গৌতম রায় হত্যাকা-ের ঘটনা। তল্লাশির মুখে পড়লে সন্ত্রাসীরা গৌতম রায়ের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে সরাসরি গুলি চালিয়ে হত্যা করে। মাদক সেবনের পর নরসিংদী সরকারী কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস ছাত্রদল নেতা বিল্লাল হোসেন রনিকে দিনদুপুরে রুবেল হত্যা করে।
পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ ধর্ষণ বা নির্যাতনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তে গাফিলতি করলে তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের চাকরিচ্যুত করার আগাম ঘোষণাও দিয়েছেন। পাশাপাশি ভিকটিমের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলেছেন। একইসঙ্গে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে মিথ্যা মামলা দায়েরকারীকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন। মাদকের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধানগণ জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন।
এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খ্যাতিমান অপরাধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, শিশু, কিশোর, কিশোরী, তরুণীসহ নানা বয়সী মানুষের যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা এবং খুনের সঙ্গে কোন না কোনভাবে মাদকের সংশ্লিষ্টতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বলতে গেলে, মাদক এসব অপরাধ সংঘটিত করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ফ্যাক্টর। মাদক নির্মূল করা জরুরী। এছাড়া ধর্ষণের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে প্রয়োজনে পাড়া মহল্লায় সভা সমাবেশ করে মানুষকে বোঝানো দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও পাঠদানের মাধ্যমে মাদক সম্পর্কে ও ধর্ষণ বা এ জাতীয় অপরাধের বিষয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সমাজের মানুষকে সচেতনতা বাড়ানো দরকার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের রীতিমতো এসব বিষয়ে সতর্কতামূলক শিক্ষা দেয়া এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি পিতা মাতা ও পরিবারের সদস্যদের শিশু, নারী বা অন্য যারা পরিবারের সদস্য তাদের সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, তা খেয়াল রাখতে হবে। তাদের সন্তানকে কে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে, তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট কি তাও জানা জরুরী। সন্তানরা যেসব জিনিসের প্রতি দুর্বল সাধ্য মোতাবেক সেসব প্রয়োজন মেটানোও জরুরী।
তিনি বলেন, সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে। যার অন্যতম কারণ প্রযুক্তি। প্রযুক্তির কারণে অনেক বাজে জিনিস হাতের নাগালে চলে আসছে। স্বাভাবিক কারণে মানুষের নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ তুলনামূলক অনেক বেশি। আগে ছেলে মেয়েরা খেলাধুলা করত। এখন আর তা করতে পারছে না। কারণ ছেলে মেয়েদের তুলনায় মাঠ নেই। পর্যাপ্ত জায়গা নেই। পিতা মাতা সন্তানদের সময় দিতে পারছে না। এমন সুযোগে সন্তান মাদকাসক্ত হচ্ছে। আর মাদক সেবনের পর স্বাভাবিক কারণেই তাদের মধ্যে বয়সের কারণে হোক বা প্রযুক্তির কারণে হোক জৈবিক চাহিদা কাজ করছে। স্বাভাবিক নিয়মে যেহেতু তারা, সেসব চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছে, এজন্য ভিন্ন পথ অবলম্বন করছে। তারই ফলশ্রুতিতে ধর্ষণের মতো অপরাধ হচ্ছে।
প্রযুক্তির কারণে মানুষ যেন নীতি, নৈতিকতা, ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা ভুলে না যায়, তা সন্তানদের শেখানো জরুরী হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি আদালত এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তিও নিশ্চিত করছে। তারপরেও যেন ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধ কমছে না। ধর্ষণ, ইভটিজিং, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ পরবর্তীতে হত্যাসহ এ ধরনের অপরাধ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সামাজিক এবং ব্যক্তিগত সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। যতদিন এটি করা সম্ভব হবে না, তত দিন সমাজ থেকে এ ধরনের অপরাধ দূর করা সম্ভব হবে না।
শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক গণঅধিকার'কে জানাতে ই-মেইল করুন- dailyganoadhikar@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
দৈনিক গণঅধিকার'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।