ঢেঁকির তালে মুখর বাড়ির আঙ্গিনা, কৃষকের ঘরে ঘরে আনন্দ
প্রকাশিত : 08:54 AM, 17 November 2020 Tuesday

ঋতুবৈচিত্র্যে হেমন্তের আগমন ঘটে শীত সঙ্গে নিয়েই। বাতাসে হাল্কা ঠাণ্ডা আর কুয়াশার চাদর বুকে জড়িয়ে হেমন্ত আসে শীতের পরশ মেখে। কার্তিকের শেষে ও অগ্রহায়ণের শুরুতে চলে ধান কাটার মহোৎসব। এ সময় ফসলের ক্ষেত ভরে ওঠে সোনালি ধানের হাসিতে। সেইসঙ্গে কৃষকের মুখেও হাসি ফোটে সোনালি ফসল ঘরে ওঠার আনন্দে। হেমন্ত এলেই দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ ছেয়ে যায় হলুদ রঙে। এই শোভা দেখে কৃষকের মন নেচে ওঠে নতুন ফসল ঘরে তোলার আনন্দে। বাড়ির গৃহবধূ থেকে শুরু করে কিশোরীরা পর্যন্ত ঢেঁকির তালে তালে নাচতে থাকে নবান্নের আনন্দে। গ্রামে গ্রামে চলে এই নবান্ন উৎসব।
প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালীর জীবনে অগ্রহায়ণ কৃষকের নতুন বার্তা নিয়ে আসে। নবান্ন হচ্ছে হেমন্তের প্রাণ। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি পিঠা, পায়েস, ক্ষীরসহ নানারকম খাবারে মুখরিত হয়ে ওঠে বাঙালীর প্রতিটি ঘর। নতুন ধানের পিঠা পায়েসের ঘ্রাণে ভরে ওঠে চারপাশ। নতুন ধান ঘরে আসার পর শুরু হয় চালের তৈরি পিঠাপুলি খাওয়ার নবান্ন উৎসব। বাঙালীর ঘরে ঘরে নবান্নের হইচই পড়ে যায়। চিরাচরিত এ উৎসব আমাদের সংস্কতির শেকড়ের অংশ।
জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়/হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/ কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।’ কবির কবিতার মতোই নবান্নে এসে ধরা পড়ে চিরায়ত বাংলার রূপ।
বাংলাদেশের অধিকাংশ উৎসবই ঋতুভিত্তিক এবং কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। গ্রাম বাংলায় নবান্ন এ ধরনের একটি উৎসব। অগ্রহায়ণ মাসে নতুন ধানের ভাত ও বিভিন্ন তরকারিসহ যে খাদ্যদ্রব্য পরিবেশন করা হয় তাই নবান্ন। অগ্র মানে প্রথমে ‘হায়ণ’ মানে মাস অর্থাৎ বছরের প্রথম মাস। একসময় অগ্রহায়ণই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস। নবান্ন কৃষিভিত্তিক উৎসব হলেও এটি একটি ঋতুভিত্তিক উৎসবও। ইতিহাস বলে অস্ট্রিক জনগোষ্ঠী আমাদের এ অঞ্চলে একদা কৃষি কাজের সূচনা করেছিল। কাজেই এই উৎসবও যে তাদের হাত ধরেই যাত্রা শুরু করেছিল তাতে সন্দেহ নেই।
লোক-গবেষক শামসুজ্জামান খান বলেছেন, নবান্ন উৎসব বা বাংলা নববর্ষের দিনের আমানি উৎসব-এর পেছনে আদিম সংস্কার বা জাদুবিশ্বাসের প্রভাব থাকতে পারে। এমনকি এর সঙ্গে উর্বরতার শক্তি পূজার সম্পর্ক থাকাও অস্বাভাবিক নয়। এই উর্বরতার শক্তি পূজার সঙ্গে অস্ট্রিকদের অধিক শস্য উৎপাদন বিশ্বাসের সম্পর্ক ঘটে যাওয়াও বিচিত্র নয়। আমানি, নবান্নের মতোই আরেক কৃষি উৎসবের নাম আখের-বাখার’।
এ অনুষ্ঠানে কোন দেবতার পুজো নেই। এ অনুষ্ঠানটি একইসঙ্গে জাদু বিশ্বাসমূলক এবং প্রথাগত আচার অনুষ্ঠানের। এর শব্দবন্ধে মুসলিম অনুষঙ্গ লক্ষণীয়। বলা হয়, আখের বাখার অর্থ শস্যভাণ্ডার মাড়াই।
ফরাসী নৃবিজ্ঞানী কার্দ দ্য কুকদ সভ্যতার যে বিকাশের কথা বলেছেন তাতে নবান্নকে ফসল উৎপাদন এবং ফসলকে খাদ্যরূপে গ্রহণের আনন্দ উৎসব হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
ফোকলোর- গবেষক ড. আশরাফ সিদ্দিকী কৃষিভিত্তিক সমাজের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘শিবায়নে পাওয়া যায় শিব একাই কয়েক শ’ প্রকার ধানের চাষ করতেন। এ অঞ্চলের কয়েক শ’ প্রকার ধানের কথা জানা যায়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- অঞ্চনলক্ষী, অমৃতশালী, আকাশ মণি, আঙ্গুরশালী, উত্তমশালী, কপিলভোগ, করমশাল কাজলা, কাটারিভোগ, রাজভোগ, নেত্রমালী, কাশফুল, কার্তিকা, কালজিরা, কালামানিক, জনকরাজ, রাজভোগ প্রভৃতি। বাংলার মাটিতে অতি সমৃদ্ধিশালী এ রকম শত শত ধানের চাষ হলেও আজ হাইব্রিডের প্রভাবে সেই ঐহিহ্য বিলুপ্ত প্রায়।
শ্রী দীনেন্দ্রনাথ রায়ের ‘নবান্ন’ প্রবন্ধ থেকে তৎকালীন বাঙালী সমাজের নবান্ন আয়োজনের একটি চিত্র পাওয়া যায়। তিনি বর্ণনা করেন, ‘অবশেষে নবান্নের আয়োজন আরম্ভ হইল।’
মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী থেকে জানান, ‘হেমন্তে কাটা হবে ধান, আবার শূন্য গোলায়-জাগবে ফসলের বান’…। কবির এ বাক্যের পরিপূর্ণতা পেয়েছে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের স্বর্ণালী মাঠে মাঠে। অগ্রহায়ণের প্রথমদিন সোমবার একযোগে শুরু হয়েছে এ অঞ্চলে ধান কাটার উৎসব। হিম হিম হেমন্ত দিনে বর্ণিল আয়োজনে নবান্ন শুরু হলো রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চৈতন্যপুরে।
হেমন্তের সোনাঝরা রোদ্রকরোজ্জ্বল দিনে রাজশাহী অঞ্চলে হাল্কা কুয়াশা ভেদ করে শুরু হলো এবারের অগ্রহায়ণের প্রথমদিন। দিনটি এলো কৃষকের আনন্দধারা হয়ে। মাঠের সোনালি পাকা ধানের ঢেউ যেন উঠে এলো কৃষকের উঠানে। কৃষকের এ আনন্দধারার উপলক্ষ-বাড়ির উঠোনে নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধ। এখন কালটা হেমন্ত। অগ্রহায়ণ তার দ্বিতীয় মাস। কৃষকের মনে তাই নতুন ধানের স্বপ্ন।
ব্যতিক্রম হয়নি রাজশাহী অঞ্চলে। জেলার গোদাগাড়ী, চারঘাট, তানোরসহ বিভিন্ন উপজেলায় অগ্রহায়ণের শুরুরদিন থেকে শুরু হয়েছে নবান্ন উৎসব। একযোগে ধান কাটার মধুক্ষণ। রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায় নবান্ন উৎসব শুরু হয়েছে একযোগে রবিবার থেকেই।
নিজস্ব সংবাদদাতা সান্তাহার থেকে জানান, সোমবার বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার গ্রামগুলোতে কৃষকের ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসব পালিত হয়েছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারী নির্দেশনার কারণে যুগ যুগ ধরে চলে আসা বাঙালীর আনন্দের এদিনটি পালনে এবারও তেমন কোন ব্যতিক্রম ছিল না। সীমিত আকারে গ্রামীণ মেলা ছাড়াও পাড়া মহল্লায় পশু জবাই করে ভাগাভাগি করে নিয়ে নতুন ধানের চালে রান্না করা পোলাও এবং সাদা ভাত খেয়েছে দুপুরে। রাতে হবে পিঠাপুলি এবং নতুন চালের আটা-গুড় ও ছাঁচি কলা দিয়ে শিরনি তৈরি করে আত্মীয়-স্বজন আর পাড়া-প্রতিবেশীদের নিয়ে খাবার ধুম।
নিজস্ব সংবাদদাতা নওগাঁ থেকে জানান, জেলার ধামইরহাটের চিরি নদীর দ্্ুই পাড়ের কৃষকদের মাঝে পালিত হলো নবান্নের উৎসব। প্রতি বছরের ন্যায় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই দিনটিকে ওই এলাকার কৃষকরা পালন করে। তবে এবার ধানের দাম বেশি পাওয়ায় তাদের মাঝে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। প্রতিটি গ্রামে ফিরে এসেছে নবান্নের উৎসবের আমেজ।
শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক গণঅধিকার'কে জানাতে ই-মেইল করুন- dailyganoadhikar@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
দৈনিক গণঅধিকার'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।