কুষ্টিয়ায় এবার বিপ্লবী বাঘা যতীনের ভাস্কর্য ভাংচুর
প্রকাশিত : 11:13 AM, 19 December 2020 Saturday

কুষ্টিয়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙ্গার পর এবার দুর্বৃত্তদের নজর পড়েছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা শহীদ বীর বিপ্লবী বাঘা যতীনের আবক্ষ ভাস্কর্যের ওপর। রাতের অন্ধকারে তারা ভাস্কর্যটি ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করে। বৃহস্পতিবার রাতের কোন এক সময় কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। ভাস্কর্যটি কয়া গ্রামে বাঘা যতীনের জন্মভিটা এবং কয়া মহাবিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে কুষ্টিয়া-শিলাইদহ সড়কের পাশে স্থাপিত। শুক্রবার সকালে বিষয়টি স্থানীয়দের দৃষ্টিগোচর হয়। পরে খবর পেয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ভাস্কর্যটির নাক ও চোয়ালের অংশবিশেষ ভেঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে দুর্বৃত্তরা। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ঘটনায় কয়া মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ও সভাপতিসহ চার জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে বিপ্লবী বাঘা যতীনের বাস্তুভিটা এলাকায় কয়া মহাবিদ্যালয়ের মূল গেটের সামনে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অকুতোভয় অন্যতম যোদ্ধা বাঘা যতীনের আবক্ষ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়। বৃহস্পতিবার রাতে ভাস্কর্যটির নাক ভেঙ্গে ফেলে দুর্বৃত্তরা। এছাড়া চোয়ালের অংশবিশেষের ক্ষতি করা হয়। গত ৪ ডিসেম্বর রাত দুটার দিকে কুষ্টিয়া শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙ্গার পর বাঘা যতীনের ভাস্কর্য ভাঙ্গার এটি দ্বিতীয় ঘটনা ঘটল। এদিকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙ্গার পর আবারও বাঘা যতীনের ভাস্কর্য ভাঙ্গার ঘটনায় কয়া কলেজের শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ন্যক্কারজনক এ ঘটনার সঙ্গে কে বা কারা জড়িত তা পুলিশ এখনও নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। তবে একটি সংগঠিত চক্র এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলে পুলিশ ও স্থানীয়রা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে।
কয়ামহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হারুন-অর- রশিদ জানান, রাতের অন্ধকারে কে বা কারা ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটিয়েছে। ভাস্কর্য ভাংচুরের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি। কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজীবুল ইসলাম খান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, কে বা কারা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। খুব অল্প সময়ের মধ্যে দুর্বৃত্তরা ভাস্কর্যটির নাক ও চোয়ালের অংশবিশেষ ক্ষতিসাধন করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে শীঘ্রই তাদের শাস্তির আওতায় আনতে পুলিশ তদন্ত কাজ শুরু করেছে। ঘটনাস্থলে বর্তমানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। অপরদিকে শুক্রবার বেলা দেড়টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার এসএম তানভীর আরাফাত সাংবাদিকদের বলেন, এ ঘটনায় কুমারখালী থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। পিবিআই জেলা গোয়েন্দা পুলিশসহ পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা বিষয়টি দেখছেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙ্গার পর সংসদ সদস্যদের উপস্থিতিতে জেলা প্রশাসন, পুলিশসহ প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয় যে, যেখানেই ভাস্কর্য আছে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সিসি ক্যামেরা স্থাপনসহ সব রকম ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু এখানে যে বাঘা যতীনের আবক্ষ ভাস্কর্যটি আছে সেটা আমাদের জানানো হয়নি। সে কারণে কলেজ কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারেন না। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কুমারখালী থানার ওসি মজিবুর রহমান জানান, সংঘটিত অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে পুলিশ মাঠে নেমেছে। যারাই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকুক কেন, তাদের কোন রেহাই নেই।
এদিকে ভাস্কর্য ভাঙ্গার ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কয়া মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হারুন-অর-রশিদ, কলেজ কমিটির সভাপতি এ্যাডভোকেট নিজামুল হক, নৈশ প্রহরী খলিলুর রহমান খলিল ও কয়া ইউপি যুবলীগ সভাপতি আনিসুর রহমান আনিসকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে বলে পুলিশ সূত্র জানায়। কুমারখালী উপজেলা প্রশাসনের বাস্তবায়নে ২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আবদুস সামাদ।
প্রসঙ্গত, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রবাদপুরুষ বীর যোদ্ধা বিপ্লবী ‘বাঘা যতীন’ এর পুরো নাম ‘যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়’। বাঘা যতীন ১৮৭৯ সালের ৭ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মাতার নাম শরৎশশী। ঝিনাইদহ জেলার হরিনাকুণ্ড উপজেলার ঋষখানি গ্রামে তাদের পৈত্রিক বাড়ি। মা ও বড় বোন বিনোদবালার সঙ্গে মাতামহের বাড়ি কয়া গ্রামে আসেন তিনি। যতীন শৈশব থেকেই শারীরিক শক্তির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। কথিত আছে, প্রথম যৌবনে একদিন তিনি বড় ভাইয়ের সঙ্গে জঙ্গলে বাঘ শিকার করতে যান। তার ভাই একটি বাঘের ওপর গুলি ছুড়লে বাঘটি সামান্য আঘাত পায়। ক্ষিপ্ত বাঘ লাফ দিয়ে যতীনের ওপর আছড়ে পড়লে শুরু হয় বাঘে-মানুষে মল্লযুদ্ধ। অসাধারণ সাহস ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে যুদ্ধ করে শারীরিক শক্তি এবং কৌশলে ও ছোরার আঘাতে তিনি বাঘটি মেরে ফেলেন। সেই থেকে তিনি বনে যান ‘বাঘা যতীন’। ১৮৯৫ সালে এন্ট্রান্স পাস করে তিনি কলকাতা সেন্ট্রাল কলেজে ভর্তি হন। যতীন ছিলেন শক্ত-সামর্থ্য ও নির্ভীকচিত্ত এক যুবক। একই সঙ্গে তাঁর মধ্যে ছিল দৃঢ় আত্মমর্যাদা ও জাতীয়তাবোধ। ১৯০৩ সালে শ্রী অরবিন্দের সঙ্গে পরিচিত হয়ে যতীন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। বিংশ শতকের শুরুতে এ অঞ্চলে বহুসংখ্যক বৈপ্লবিক গুপ্ত সমিতি গড়ে ওঠে। শ্রী অরবিন্দ ঘোষ ও যতীন্দ্রনাথ ছিলেন এ অঞ্চলে বৈপ্লবিক মন্ত্রের জন্মদাতা। ঢাকার হেমচন্দ্র ঘোষ, মাস্টার আলীম উদ্দিন ও প্রমথ চৌধুরী ১৯০৫ সালে মুক্তিসংঘ নামে গুপ্ত সমিতি গঠন করেন। এ মুক্তিসংঘই পরবর্তীকালে ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ নামে ইংরেজ শাসনের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাঘা যতীন ছিলেন বাংলার সন্ত্রাসবাদী বৈপ্লবিক আন্দোলনের এক প্রবাদপুরুষ। তার প্রচেষ্টা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সে সময় কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ অঞ্চলে বিপ্লবী দলের তৎপরতা ব্যাপকতা লাভ করে। তারই প্রচেষ্টায় কুমারখালী, খোকসা, হরিনারায়ণপুর, গোঁসাই দুর্গাপুর, ঝিনাইদহ, ঋষখালি প্রভৃতি স্থানে গড়ে ওঠে যুগান্তর দলের সক্রিয় ঘাঁটি। এদিকে সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম ফাঁস হয়ে পড়লে যতীন কলকাতায় পালিয়ে যান এবং স্বল্পকালের মধ্যেই বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সর্বত্র পরিচিতি লাভ করেন। ইতোমধ্যে যতীনকে বিপ্লবী দলসমূহের কমান্ডার-ইন-চীফ করা হয়। এদিকে সশস্ত্র বিপ্লবের কারণে বাঘা যতীনকে ধরতে পুলিশী তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। বাধ্য হয়েই তিনি উড়িষ্যার বালেশ্বরে গিয়ে আত্মগোপন করেন। ভূপতি মজুমদার ও নরেন্দ্র ভট্টাচার্য যতীনকে সেখানে রেখে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য যান বাটাভিয়ায়। পরে পুলিশ যতীনের গুপ্ত অবস্থানের সন্ধান পেলে বালেশ্বরে এক সম্মুখযুদ্ধে ১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তিনি গুরুতর আহত হন এবং ১০ সেপ্টেম্বর মাত্র ৩৫ বছর বয়সে বালেশ্বর হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
শেয়ার করে সঙ্গে থাকুন, আপনার অশুভ মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি দৈনিক গণঅধিকার'কে জানাতে ই-মেইল করুন- dailyganoadhikar@gmail.com আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।
দৈনিক গণঅধিকার'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।